হোয়াট ইজ আর্ট?
তন্ময় বীর


উৎসর্গপত্র-র দিকে আঙুল দেখিয়ে সুবীরদা বললো, এটা আবার লিখতে হয় নাকি!–

লেখা ছিল “সুরমাকে ভালোবেসে–”

যখন লেখা হচ্ছিল, প্রুফ দেখা চলছিল, বারবার টাইপ করা ছেলেটিকে বোঝাতে হচ্ছিল, এই লেখাটা যাবে সমস্তটা সাদা রেখে একেবারে নিচের থেকে চার লাইন উপরে ডান দিকে, তখন একবারও মনে হয়নি ভাষাটায় সূক্ষ্মতা হারাচ্ছে। লঘু হয়ে যাচ্ছে ‘ভালোবাসার’ ভার। এই প্রথম খচ্‌ করে উঠলো, তাও উদ্বোধনের দিনই। কানে করাতের অস্বস্তি জাগালো কথাগুলো, --“বউকে দিচ্ছ, আবার লিখেও দিচ্ছ ভালোবেসে দিচ্ছ! মাঠে মারলে তো উৎসর্গের আর্ট-টা!” কানের কাছে মাথা এনে অন্তরঙ্গতার ভাব এনেও সকলকে শুনিয়ে বলল, --“বউকে চুমু দিয়ে বলো নাকি এটা কিন্তু ভালোবেসে দিলাম!” “আমরা ঠিক বুঝতে পারি কোনটা চব্বিশ ক্যারেট, সার্টিফিকেট লাগে না।” -- সুচন্দ্রা পাশ থেকে কটাক্ষ হেনে দুল নাচিয়ে সুযোগের সদ্বব্যবহার করল। মানিক’দা বলল, --“ও! এবার বুঝেছি কেন তোমরা ঠোটরঞ্জনী লাগাও।” ঠোটরঞ্জনী কথাটায় হাহাহিহি শুরু হলো। তারপর কথার গাড়ি ছুটল নানান দিকে। কিন্তু মনের মধ্যেটা খিচ্‌ড়ে রইল। কিছুতেই বইপ্রকাশ উপলক্ষ্যে আজকের সব বিল নিজের গ্যাঁট থেকে বার করতে ইচ্ছে করছিল না। কফিহাউস থেকে ফিরতি বাসে ব’সে ব’সে ভাবছিলাম, সত্যি তো, নামের পর শুধু ওই হাইফেনটাই যথেষ্ট ছিল। কন্ডাক্টারকে ভাড়া দিতে ভুলে গেলাম, নামার সময় দুটো কথা শোনালো, ইচ্ছা করে পরের স্টপেজে নামালো... নামিয়ে দিয়ে খালাসিও টিপ্পনী কাটলো।

অন্য দিন হলে হয়তো এসব গায়ে মাখতাম না, ভাবতাম ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-এর বেলায় ইংরেজি আর খালাসি-র বেলায় বাংলা কেন! আজ উল্টোটাই হলো, পুরো মেজাজটাই তিরিক্ষে হয়ে গেল। বাড়ি যে আছে, সেটা ভুলেই বাড়িতে ঢুকলাম।



বাড়িতে পা দিতেই শুরু হলো সংসারের বিরুদ্ধে সমস্ত পৃথিবীর ষড়যন্ত্রের কাহিনী। ঝি আসেনি, অবাধ্য সন্তান, অকম্মা শাশুড়ি, গ্যাস নেই, কী আনার কথা ছিল, কী আনিনি, সংসারের প্রতি কর্তার অমনোযোগের সাতকাহন...

ঝন্‌ ঝন্‌ করে উঠল মাথার মধ্যে...

বহির্প্রকাশটাও সেরকম অনিয়ন্ত্রিত রূঢ় সশব্দ হলো। সকলকে সন্ত্রস্ত করে শুয়ে পড়লাম অসহ্য মাথাব্যথা নিয়ে।



ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত অনেকই হবে। খাটের ওপাশ থেকে চাপা ফোঁপানির শব্দে চেতনা এলো। মাথার মধ্যে অস্থিরতাটা বেশ থিতিয়ে এসেছে। নড়লাম না, চুপ ক’রে থাকলাম, তা-ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে বার্তা পৌঁছে গেল ঠিক, --“...কুড়ি বছর ঘানি টানছি। আত্মীয়-স্বজন সব পর করে দিয়েছি। বছরে একবার নমো নমো বাইরে যাওয়া, ব্যাস, তারপর তিন’শ ষাট দিন গারদবন্দি। আমি কী নিজের জন্যে বলি, আমি কী একা খাই... ওই সব কাব্যি করা কাউকে তো বাছলেই হতো, কাব্যি পুড়িয়ে যজ্ঞি করতো... কবিতায় ফর্দ লিখতো!”

শব্দব্রহ্ম, আর কথা বাড়ালাম না। একটু গলার আওয়াজ করে সন্ধিপ্রস্তাব দিলাম –

“আবার পাড়া জাগিয়ে জানান দেওয়া হচ্ছে, আমি কতটা খারাপ। ছেলে, শাশুড়ি সকলের সামনে...”

দেখলাম সন্ধি নয় পরাজয়ই শ্রেয়, যেন আকাশকে শোনালাম, “ভুল হয়ে গেছে...”

“ সেটা তো লোকে জানলো না... প্রেমের গপ্প লেখা হয়! বাড়িতে একদিনও তো রসের কণাও ঝরে না বাক্যিতে...”

“ভুল হয়ে গেছে।”

“ভুল হয়ে গেছে বললেই সাত খুন মাপ!”

“দুটো ভুল হয়েছে তাই দু’বার।”

ও পাশের নিস্তব্ধতাই জিজ্ঞাসা চিহ্ন।

বললাম, “নতুন বইটার উৎসর্গপত্রে একটা ভুল...”

...

কাঁধের দাগটা জামায় ঢাকা পড়বে, ঠোঁটের নিচেরটার কার্যকারণ সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য সকালে উঠেই দাড়ি কামাতে বসতে হলো। তারপর বেশ মোটা করে বোরোলীন লাগিয়ে বাজার; উৎসর্গপত্র রচনার অভিনন্দনভোজের উপকরণ আনতে। যা আমি কাল আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। বই প্রকাশের ব্যতিব্যস্ততায় সিগনালটা ঠিক ডিকোড করতে পারিনি।



তিনদিন পর সেই বিলীয়মান দাগে সযত্নে হাত বোলাতে বোলাতে সুবীরদাকে ফোন করলাম। ওঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, “কালিমাটিতে একটা গল্প বেরোচ্ছে, পড়বেন!”

Comments