গুয়াহাটি পর্ব- ৩

তন্ময় বীর

ভেবেছিলাম নামার সময়ও হেঁটে নামবো। কামাখ্যা খুব একটা উঁচু বলে মনে হয়নি। সবে মাত্র একটা ব্যর্থতার নদীঘাট থেকে ফিরেছি।  লাইনে দাঁড়িয়ে দেবীদর্শন, প্রকৃতার্থে বলা যায় মন্দিরের অন্দরদর্শন; ধর্মস্থানের ভেতর নিয়ে আমি বরাবর সোৎসুক, মানুষের চিররহস্যাবৃত অন্তরমহল যেন তার দোসর পেয়েছে এখানে; ভক্তদের উচ্চস্বরে দেবীমহিমাগানে অনাবিল আকুতি, ধন্যবাদ আর আবেদনের মূর্ত প্রশ্বাস নিশ্বাস ও জয়ধ্বনিস্রোতে মিশে গিয়ে আবার স্পষ্টআকাশতলে স্বতন্ত্র হতে সন্ধ্যা নামল। ততক্ষণে ঝলমলিয়ে উঠেছে  তমোনাশ সভ্যতার আলো। তবু মনে হল কতটুকু আর পথ? বরং বেশ ভালোই লাগবে পাহাড়ি রাস্তায় সান্ধ্য অবতরণ।  ধর্ম – মানুষের আদিম অন্ধকার কন্দর, আর প্রকৃতির নিজস্ব নিশা এদের ভেতর দিয়ে সভ্যতার স্পষ্টালোকের দিকে হাঁটা বেশ লোভনীয় মনে হল। কিন্তু সাথী বলে উঠল, ‘অসম্ভব; দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাজপথে বাঘ দাঁড়িয়ে থাকার খবর কি পড়ো নি!’ অগত্যা গাড়ি...

বাঘ নেমে আসে

পথ খুব শ্বাপদসংকুল

উজ্জ্বল মাংসাশী নামে

আদিম আঁধার থেকে

বহ্নিমান স্পষ্ট দিবালোকে

নিজের ভিতর তাকানো গেল, আমরা কেউই স্পষ্ট আলোকে নিজের সবটুকু দেখিনি, আমি-র মধ্যেই রয়েছে তমসা শেষহীন। সেখানে স্বল্প হলেও জেগে আছেন মৌলিক রিপুগণ। শ্বাপদের দাঁত- নখ একনম্বর অ্যান্টি ক্যাভেটি পেস্টের প্রত্যহ মাজন উপেক্ষা করেও সগৌরবে টিঁকে আছে। সভ্যতার সীমা বজায় রাখলে সেসব খুব একটা গর্হিত নয়, বরং স্বাভাবিক। মনে হল এই যে অপরিচিতা অন্ধকারে নির্জনে হাঁটতে চাওয়া তার অতলেও কি রয়েছে সামান্য চতুষ্পদী আকাঙ্ক্ষা! –

সম্পর্কের ভিতর

কিছুটা তমসা শ্রেয়

কিঞ্চিৎ গুহ্য আমিষ

ন্যূনাধিক চতুষ্পদী

অমার্জিত নয় খুব

আত্মপ্রচার, অর্জনের সমাপ্তিহীন প্রচেষ্টাপুজা, চতুর্দিকে প্রগতির হৈ হৈ-কার, এও তো এক প্রকার পুণ্যলোভী ধর্মভীরুর মতন। সব ভুলে, সব ফেলে উন্নয়নের ধ্বজাপুজো, তার ডঙ্কা রবে প্রাকৃতিক সামঞ্জস্যের ত্রাহি ত্রাহি।   জীবনের, জগতের স্বাভাবিক গোপনতা বুঝি আর গোপন থাকে না, রহস্য সব মাঠে মারা যায় –

নাদবিস্তারী মন্ত্রোচ্চার

পুন্যলোভাতুর ধ্বজাপুজো

নিত্যযজ্ঞধুমে আলোকিত

স্পন্দিত নিভৃত গোপন



দেখেছি পাহাড়ের মাথায় মোবাইলের টাওয়ার পৌরুষের দম্ভে দণ্ডায়মান। গভীর অরণ্যানীর সতীত্ব চিরে এই যে রাজপথের  মসৃণ সটান শয়ান, এরাই তো উন্মুক্ত করে দিচ্ছে সব – প্রকৃতির নির্জনতা থেকে মানুষের অন্তরঙ্গ নিজস্বতা –

চূড়ায় চূড়ায় উদ্ধত পরুষ

বুকচেরা প্রশস্ত মসৃণ

আগ্রাসী সন্ধানী নজর

উন্মুক্ত করে দিচ্ছে

চুম্বন প্রসব আলিঙ্গন

প্রকৃত নিসর্গ থেকে আমাদের নির্মিত বা নিয়ন্ত্রিত নিসর্গ আনেক বেশি স-বাক, স্মার্ট, আলোকিত। ভেতরে বয়ে চলা সেই আকাঙ্ক্ষা কল্পভূমি থেকে এবার বাস্তবে নেমে পড়ে।  সাময়িকতা ছেড়ে ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। সামান্য থেকে সাধারণ।  যেন আর যানযাত্রী নই। চলেছি সেই প্রথম ইচ্ছে অনুযায়ী। পর্বতবৃক্ষমর্মরের রাত্রিসিম্ফনিতে আকস্মিক  অযাচিত ধ্বনিতে সভয়া  তুমি লগ্ন হবে বাহুতে আমার। নবকুমার-কপালকুণ্ডলার চরিত্রে প্রকৃতিনির্ভয়তা কি তাদের ব্যর্থ দাম্পত্যের একটি কারণ?  কিন্তু ক্ষণিকেই স্বপ্নভগ্ন হয়, চারিদিকে এতো আলো, সুরক্ষা  আমাদের স্পন্দিত হওয়ার অবকাশই উধাও –

এ প্রগলভ নিসর্গে

কীভাবে আরও একটু

লগ্ন হবে বাহুতে আমার

ভয়াতুর –

শুধুই কী আশ্রয়হীন নিরুপায় শ্বাপদ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের ভেতরের সেই মৌলিক শ্বাপদ বৃত্তিও তো নিরুপায় বেরিয়ে এসেছে প্রকাশ্যে। অনেক পরে মনে হয়েছিলো নিরুপায় নয় শুধু বিকৃত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। যেদিন শোনা গেল একটি মেয়েকে প্রকাশ্য রাস্তায় লাঞ্ছিত করে  কয়েকটি যুবক। আর আর একটি লেজওয়ালা প্রতিবাদের পরিবর্তে ক্যামেরা বন্দী করে সে দৃশ্য –

সড়কে নেমেছে

ত্রস্ত লাঙ্গুল কৃন্তক ছেদক

নানা মাত্রায় ভাবনাকে চারিয়ে দেয় এই দুটি লাইন। শরীর ছেড়ে পৃথক হয়ে এসেছে প্রত্যঙ্গগুলি। আর শেষের দুটি লাইন যদিও ফিরে যেতে চেয়েছে একান্ত ব্যক্তিক সম্পর্কের দিকে কিন্তু তার আগেই বিনষ্ট গোধূলি বীথিকার আর্তনাদ আর রোমাঞ্চহীন অস্তিত্বের বিষাদ সব তেতো করে দিয়েছে –

গোধূলি বীথিকায়

আমাদের আর কোনও রোমাঞ্চ নেই।
 
সব মিলিয়ে কবিতাটি দাঁড়িয়েছে এরকম –


বাঘ নেমে আসে

পথ খুব শ্বাপদসংকুল

উজ্জ্বল মাংসাশী নামে

আদিম আঁধার থেকে

বহ্নিমান স্পষ্ট দিবালোকে

 

সম্পর্কের ভিতর

কিছুটা তমসা শ্রেয়

কিঞ্চিৎ গুহ্য আমিষ

ন্যূনাধিক চতুষ্পদী

অমার্জিত নয় খুব

 

নাদবিস্তারী মন্ত্রোচ্চার

পুণ্যলোভাতুর ধ্বজাপুজো

নিত্যযজ্ঞধুমে আলোকিত

স্পন্দিত নিভৃত গোপন

 

চূড়ায় চূড়ায় উদ্ধত পরুষ

বুকচেরা প্রশস্ত মসৃণ

আগ্রাসী সন্ধানী নজর

উন্মুক্ত করে দিচ্ছে

চুম্বন প্রসব আলিঙ্গন

 

এ প্রগলভ নিসর্গে

কীভাবে আরও একটু

লগ্ন হবে বাহুতে আমার

ভয়াতুর –

 

সড়কে নেমেছে

ত্রস্ত লাঙ্গুল কৃন্তক ছেদক

 

গোধূলি বীথিকায়

আমাদের আর কোনও রোমাঞ্চ নেই।

Comments